বেকারত্ব, উচ্চশিক্ষা এবং আমাদের বাস্তবতা।

author
0 minutes, 1 second Read

প্রমথ চৌধুরীর ভাষ্যমতে,“শিক্ষার উদ্দেশ্যে গলাধঃকরণ নয় বরং শিক্ষার্থীর মনে শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ তৈরী করে দেয়া।” এর মাধ্যমেই একজন শিক্ষার্থী শিক্ষার প্রকৃত স্বাদ উপলব্ধি করতে পারে।

একসময় আমাদের আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাট্রিক বা হাল আমলের এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াকে সাদরে গ্রহন করা হতো। বাস্তবতার নিরিখে যা এখন স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্সে গিয়ে ঠেকেছে!

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের(ইউজিসি) তথ্য মতে দেশে এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫২টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৮ টি। দেশে আরও পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নীতিগত অনুমোদনের অপেক্ষায়। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় দৃশ্যমান।

কোনো একটি কাজ ইতিবাচক কী না? -তা পরিমাপ করার একমাত্র মানদণ্ড কাজটি কতটা ইমফ্যাক্ট ফেলতে পারে সংশ্লিষ্ট সেক্টরে। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সনদধারী তরুণের সংখ্যা যার প্রায় সমার্থক শব্দ সনদধারী বেকারের সংখ্যা!

একজন মানুষ যখন পেশা হিসাবে কাজ খুঁজে পায়না তখন তাকে বেকার বলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। প্রতিবেদনটি ইতিবাচক কীনা তাও অস্পষ্ট। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদন অনুযায়ী এই মূহুর্তে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি।
বেকারদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে, বিআইডিএসের এক জরিপে দেখা গেছে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৪ শতাংশ এবং স্নাতক পর্যায়ে এই হার ৩৭ শতাংশের কাছাকাছি। ধারণা করা হয়ে থাকে দেশে প্রতিবছর ২০ লাখের বেশী জনশক্তি শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্ত হয়। যেখানে প্রথম আলো ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী কর্মসংস্থানের মাত্র তিন শতাংশ সরকারি খাতে আর ৯৭ শতাংশই বেসরকারি উৎসে! ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) সাম্প্রতিক এক জরিপ মতে, দেশে বর্তমান ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার! -বণিকবার্তা ডিসেম্বর, ১৫,২০২২।

সরকার উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য করার ফলে এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক উপজেলাতেও উচ্চশিক্ষার সুবিধা মিলছে, একটা উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে আমাদের সীমাবদ্ধতা অনেক কিন্তু আমরা আামাদের সীমিত সম্পদের কতটুকু ব্যবহার করতে পারছি।

অস্বস্তির বিষয় হচ্ছে একদিকে দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের হার বাড়ছে, কিন্তু দেশের প্রধান চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলা দক্ষ মানব সম্পদের অভাবে ভুগছে। এ অভাব পূরণে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবেশী দেশগুলা থেকে উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন জনশক্তি আমদানি করায় বাংলাদেশকে বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে। প্রসঙ্গত শুধু ভারতের জনশক্তিই বছরে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার তাদের দেশে রেমিট্যান্স হিসাবে পাঠাচ্ছে।

আমাদের দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাকরির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ গ্র্যাজুয়েট সৃষ্টি করার চেষ্টা করলেও আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো পুরোনো কারিকুলামে বসে আছে। জ্ঞানের বিকাশে অবশ্যই মৌলিক বিষয়ের গুরুত্ব আছে তবে মৌলিক বিষয়ের সাথে যুগোপযোগীতার মিশেল দেওয়ার কোনো আগ্রহ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের লক্ষ্য করা যায়না। আমাদের সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যাবহার করতে এখন প্রায়োগিক জ্ঞানের প্রতি আমাদের বিশেষ নজর দেওয়া জরুরী।
একইসাথে আমাদের বিশ্বিবদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরীণ আবাসিক সমস্যা, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র রাজনীতিতে ডমিনেট করার কালচার এসব বাস্তবতাকেও সমাধান করতে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে।

চাকরীর পাশাপাশি নতুন ব্যবসা বা উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করতে অর্থসংস্থান নিয়ে বাধা; বিভিন্ন ধরনের অনুমতি বা লাইসেন্স, আয়কর প্রদান, সরকারি বা ব্যাংক ঋণসংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো সহজবান্ধব প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নাগরিক সেবা পেতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা দেখা দিলেও উদ্যোক্তা হিসেবে টিকে থাকা তাদের পক্ষে বেশ দুরূহ ব্যাপার। নতুন কোনো উদ্যোগ নিতে বিভিন্ন রকমের পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়। নারীদের জন্য উদ্যোক্তা হওয়া তো আরো কঠিন; থাকে নানা পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। এসব কারণে দিনশেষে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী হয়।

আর এসবের সাথে পাল্লা দিয়ে তরুণদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। প্রথম আলো ২০, জানুয়ারী, ২০২৩ এর নিউজ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের(কুমেক) এক শিক্ষানবিশ ডাক্তারের আত্মহত্যা। যার কারণ হিসাবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে শিক্ষাজীবনের ব্যার্থতা।
‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয় এড়ায় না’ এই বাস্তবতাও আমাদের মনে রাখতে হবে। লাখ লাখ তরুণ ডেকে এনে বেকার বানানোর যে মেকানিজম আমরা ডেভেলপ করছি এর কিছু বখে গেলে তখন সত্যিকার অর্থে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না।

শিক্ষার্থী -নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *